গজারিয়ার গণহত্যা নিয়ে স্বপ্ন ’৭১ এ ধারাবাহিকভাবে আলোকচিত্রী ও গবেষক সাহাদাত পারভেজ লিখছেন গজারিয়া গণহত্যা : প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান। আজ ৩২তম পর্ব। জানাবো : মো. ফারুক রাড়ী (মিন্টু), পিতা : আবদুর রব রাড়ী (শহীদ), মাতা : শান্তি বেগম, গ্রাম : বালুচর, পেশা : ব্যবসা, বয়স : ৬০ বছর।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সন্ধ্যায় গেরিলা বাহিনী খোকা মিয়াকে ধরে নিয়ে গেলো। এতে হানাদার বাহিনীর মাথা খারাপ হয়ে যায়। এর প্রতিশোধ হিসেবে পরদিন সকালে হানাদার বাহিনী আমার বাবা আবদুর রব রাড়ীকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে বাবার আর কোনো খোঁজ নেই। বাবাকে যখন ওরা নিয়ে গেলো, তখন আমি সিক্সে পড়ি। বয়স ১১ কি ১২ বছর হবে। আমরা পাঁচ ভাইবোন। আমি সবার বড়। আমার ছোট ভাইয়ের বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। বাবার সবকিছুই আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা কৃষিকাজ করতেন। আমার বড় ফুফু মুন্সিগঞ্জে থাকতেন। বাবা নানা কাজে সপ্তাহে অন্তত চারদিন মুন্সিগঞ্জে যেতেন। সেদিন ছিল ২২ নভেম্বর, ৮ অগ্রহায়ণ, রোববার। দুপুর ২টার দিকে পাশের বাড়ির জনাব আলী প্রধানের কাছে খবর পেলাম, আর্মিরা বাবাকে ধরে থানায় নিয়ে গেছে। বাবা সকাল বেলা মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে গজারিয়া ফিরছিলেন। ফেরার পথে গুদারাঘাটে নামতেই আর্মিরা বাবাকে ধরে নিয়ে যায়।
আমি দৌড়ে থানায় গেলাম। থানার সামনে গিয়ে দেখি ওসি সাহেব, সুফি সাহেব আর একজন আর্মি অফিসার বসে আছেন। আমি ওই আর্মি অফিসারকে গিয়ে বললাম, ‘কেন আমার বাবাকে ধরে নিয়ে আসছেন, আমার বাবার কী অন্যায়? আপনি আমার বাবাকে ছেড়ে দিন।’ আর্মি অফিসার বললেন, ‘আমরা তোমার বাবাকে ধরি নাই। বিশ্বাস না হয় হাজতখানায় গিয়ে দেখো।’ হাজতখানায় গিয়ে দেখি ভেতরে বাবা নাই। বাবাকে না পেয়ে বাড়ি চলে আসলাম। আসলে ওরা বাবাকে হাজতখানায় না রেখে আর্মি ক্যাম্পের পেছনের বাংলোয় রেখেছে। ওই সময় ওটা বুঝতে পারি নাই। আসরের আজানের পর গেলাম তাইজ উদ্দিন ওরফে ভুট্টো মল্লিকের কাছে। ভুট্টো মল্লিক আর্মিদের নৌকা বাইতো, রান্নাবান্না করতো। আর্মিদের সঙ্গে ওর খুব সখ্য সম্পর্ক। ভুট্টো মল্লিককে বললাম, ‘চাচা, আপনি গিয়ে আমার বাবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন।’ সে গেলো না। গড়িমসি করলো। পরদিন বিকালে বাড়ির ঘাটে দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় ভুট্টো মল্লিকের ভাই আজিজ মল্লিকের সঙ্গে দেখা। সে বললো, ‘বাড়ি যাও। হায়াতে বাঁইচা থাকলে আইসা পড়বো।’
এরপর এতগুলো বছর গেলো, বাবা আসলো না। শুনেছি ঘটনার পরদিন সকালে আর্মিরা কাঁধে করে বাবার লাশ নদীর ঘাটে নিয়ে যায়। পরে একটি লঞ্চে উঠায়। লঞ্চটির নাম এমভি আজগর। শাহাবউদ্দিন নামে আমার এক ফুফাতো ভাই ছিলেন। তিনি তখন রাস্তায় মাটি কাটছিলেন। বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দূর থেকে দেখেছেন। শাহাবউদ্দিন ভাই বললেন, ‘মামাকে ওরা অনেক মারছে। মামাকে দুইজন আর্মি কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। নদীর ঘাটে একটি ছোট লঞ্চ ভিড়ানো ছিল। মামাকে তারা সেই লঞ্চে ওঠায়। তারপর লঞ্চ চলে যায় মুন্সিগঞ্জের দিকে।’ ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮, বৃহস্পতিবার আর্মিরা গজারিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর্মিরা চলে যাওয়ার পর আমার এক বড় চাচা আবদুস সোবহান সেই লঞ্চের কর্মচারীদের কাছে ঘটনার বৃত্তান্ত জানতে চান। লঞ্চের কর্মচারীরা জানায়, ‘লঞ্চটি কিছুক্ষণ চলার পর আমরা একটি গুলির শব্দ পেলাম। পরে আর বন্দি লোকটিকে দেখতে পাইনি। মাঝনদীতে যাওয়ার পর লঞ্চটিকে ঘুরাতে বলা হয়।’ বাবাকে হত্যার পর আমাদের বাড়িতে কয়েকবার হানা দিয়েছে। ওরা আমাকেও হত্যার টার্গেট করেছিল। আমি বালুয়াকান্দি ও লুটেরচরে পালিয়ে ছিলাম। বাবার আগে আমার ফুফা আবদুল আউয়াল রাড়ীকে আর্মিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাকে ছেড়ে দেয়।
বাবার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। বাবা একবার আলতো শীতে সরষে বুনতে আমাকে ক্ষেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার সারা জীবন মনে হয়েছে, বাবা ছাড়া আমি একজন অসম্পূর্ণ মানুষ। বাবা থাকলে যেসব শিখতাম, তা এই জীবনে শেখা হলো না। আমি যখন বাবা হলাম, তখন মনে হয়েছে, আমার এই খুশির দিনে বাবা পাশে নেই। আবার ভাবি, আমি তো একজন শহীদের সন্তান। তিরিশ লাখ শহীদের মাঝে আমার বাবাও একজন। সেই ভেবে গর্ব অনুভব করি। বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর বহু জায়গায় লাশ খুঁজেছি, পাই নাই। বড় হয়ে অনেকবার কল্পনা করেছি, ওটা যদি একটা দুঃস্বপ্ন হতো। প্রতিদিন প্রতীক্ষায় থাকি বাবা আসবে। কিন্তু এতগুলো বছর হয়ে গেলো, বাবা আসলো না।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ১৮ জুন ২০১৭
আরও পড়ুন :
প্রথম পর্ব : মোরশেদ আহমেদ চৌধুরী
দ্বিতীয় পর্ব : আবদুর রউফ সিকদার
তৃতীয় পর্ব : আবুল হোসেন ভুইয়া
চতুর্থ পর্ব : নূরুল আমীন প্রধান
পঞ্চম পর্ব : সালামত জেহাদ
ষষ্ঠ পর্ব : সানোয়ারা বেগম
সপ্তম পর্ব : মনোয়ারা বেগম নার্গিস
অষ্টম পর্ব : ইসহাক মোল্লাহ
নবম পর্ব : রবিদাশী বর্মণ
১০ম পর্ব : আরফাত আলী সিকদার
১১ম পর্ব : প্রল্লাদ চন্দ্র বর্মণ
১২তম পর্ব : উত্তম কুমার দাশ
১৩তম পর্ব : মোতাহার হোসেন খোকন
১৪তম পর্ব : জহিরুল ইসলাম ভুঞা
১৫ তম পর্ব : ওমর ফারুক আখন্দ
১৬ তম পর্ব : আবু বকর ছিদ্দিক
১৭ তম পর্ব : ফাতেমা বেগম
১৮তম পর্ব : কমলা বেগম
১৯তম পর্ব : রেজিয়া বেগম
২০তম পর্ব : নারায়ণ চন্দ্র বর্মণ
২১তম পর্ব : হরিদাসী বর্মণ
২২তম পর্ব : জাহানারা বেগম
২৩তম পর্ব : আবদুল হামিদ মোল্লাহ
২৪তম পর্ব : কল্পনা রানী দাশ
২৫তম পর্ব : মোসলেম উদ্দিন প্রধান
২৬তম পর্ব : হোসেন মোল্লাহ
২৭ তম পর্ব : তানেস উদ্দিন আহমেদ
২৮তম পর্ব : লুৎফর রহমান সরকার
২৯তম পর্ব : সরদার শাহজাহান
৩০ তম পর্ব : আরশাদ আলী
৩১ তম পর্ব : আমিরুল ইসলাম
***স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশিত লেখা, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।