খুব বেশিদিনের আগের কথা নয়। ২২ এপ্রিল ১৯৯৬। ৫, সেগুনবাগিচার ছোট্ট একটি দ্বিতল বাড়ির প্রাঙ্গণে বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যাত্রা শুরু।স্বাধীনতার পরবর্তী ২৪ বছরে কোনো সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ছোট্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের হাজার বছরে শ্রেষ্ঠ অর্জন, আমাদের স্বাধীনতা। ‘৭০ এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ আসন লাভ করার পরও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ক্ষুদ্ধ জনতা অহিংস প্রতিবাদ করতে থাকে। পাকস্তানি বিভিন্ন স্থানে ছত্রভঙ্গের নামে সমাবেশ-মিছিলে গুলিবর্ষণ করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বঙ্গবন্ধু এসবে বিরুদ্ধে একাত্তরের ৭ মার্চ সামরিক জান্তাকে হুশিয়ার করে জনতাকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানান। সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর হুশিয়ারকে তোয়াক্কা না করে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর নিবির্চারে গুলি করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকস্তানি বাহিনী ও তার দোসর জামায়াতে ইসলামের রাজাকার, আল বদর, আল শামসরা ৩০ লক্ষ মানুষের তাজা প্রাণ হরণ, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী, শহর-বন্দর-গ্রামের হাজার হাজার বাড়ি-ঘর লুঠপাট করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভূস্মিভুত করেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের লাশ বিনা দাফনে পথে-ঘাটে-বাটে পড়ে কাক-চিল-শকুন, কুকুর ও মাছের খাদ্যে পরিণত হয়েছিল। এক কোটি মানুষ ভারতে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল। হানাদাররা জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য বেছে বেছে শিক্ষক-সাংবাদিক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের হত্যা করেছিল।
পাকিস্তানি বাহিনীর এই নৃশংস গণহত্যা সহ্য করতে না পেরে কৃষক-শ্রমিক-মজুর, ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক, চিকিৎসক-প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁরা নয় মাসে আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
ইতিহাসের এই বিরল ঘটনাটি পরবর্তী প্রজন্মদের সামনে তুলে ধরার ঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ থেকে আটজন সাংস্কৃতিক কর্মী ও নাট্যব্যক্তিত্ব এগিয়ে আসেন। তাঁরা হলেন- নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাই, লেখক ও প্রকাশক মফিদুল হক, নাট্যব্যক্তিত্ব ও বর্তমানে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, প্রকৌশলী ও সমাজকর্মী জিয়াউদ্দীন তারিক আলী, চিত্রকলা সংগ্রাহক এবং কর্পোরেট ব্যবস্থাপক আক্কু চৌধুরী ও সাবেক বিএমএ মহাসচিব ডা. সারওয়ার আলী। তাঁরা নিজ অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। সংগ্রহ করেন অসংখ্য তথ্যচিত্র, অস্ত্রশস্ত্র, বধ্যভূমির হাড়-গোর, স্মারক চিহ্ন প্রভৃতি।
শুরুতে নাম মাত্র দুই টাকার দর্শনীর বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অপচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে পুরোপুরি বিনষ্ট করার কারণে জনসাধারণের কাছ থেকে তেমন আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় না। একটি স্নাকসবার, বই ও স্যুভেনির বিক্রয় কেন্দ্র, ছোট্ট হলঘর এবং খোলা প্রাঙ্গণ থেকে আয়কৃত ভাড়া দিয়েও প্রতিমাসের এক লক্ষ টাকার খরচ সংকুলান করা সম্ভবপর হয় না। বেশ কিছু হৃদয়বান দেশপ্রেমিক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠানটি কোনো মতে চলতে থাকে ।
বছর কয়েকের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক স্মারক আসতে থাকায় স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে পরে। বিনষ্ট এবং অনিরাপত্তজনিত কারণে নিজস্ব ভবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগজোট। তিনি আগারগাঁওতে একটি জায়গা বরাদ্দ দিলেন এবং লটারীর মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য অনুমতি প্রদান করলেন।
দেশী-বিদেশী অর্থায়নে দীর্ঘদিন প্রচেষ্টার পর গতবছর এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিজস্ব ভবনে প্রবেশ করে। দ্বারোদ্ঘাটন করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রতীকি গুলিবিদ্ধ চিহ্নিত বিশাল আকৃতির এই ভবনটি বর্তমানে সাক্ষী দিচ্ছে ‘৭১ সালে কেন বাঙালীরা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। দেশের আসার পর কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা দেখে না যেতে পারলে মনে অতৃপ্তি থেকে যাবে। তাই ভাবলাম, এটা ঘুরে যেতেই হবে। ওদিকে বিদেশের ডাক।তারপরও মনটা সইছে না। সঙ্গী হিসেবে এই সময়ে তরুণ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন মুক্ত আাসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ সুরুজকে নিয়ে চললাম। ভবনের কাছে গিয়ে যেন বুকটা ভরে গেল। বিশ টাকা করে তিনটা টিকিট কাটলাম। তারপর শুরু হলো ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়া। সেই সময়ের স্মৃতিগুলো যেন চোখের সামনে জ্বলজ্বলে করে জ্বলে উঠছে। ভবনে চারটি গ্যালারি। প্রথম গ্যালারিতে চোখে পড়ে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কালপর্বে এই জনপদের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রত্ননিদর্শন। দ্বিতীয় গ্যালারিতে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ঘটনা থেকে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী সরকার গঠন পর্ব পর্যন্ত। এই গ্যালারিতে শব্দ ও আলোর প্রক্ষেপণের একটি বিশেষ প্রদর্শনী। এতে ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বর্বরতা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণা, ৪ এপ্রিল কুষ্টিয়ার যুদ্ধ এবং সারা দেশের গণহত্যার নিদর্শন থাকে এই গ্যালারিতে। আর উদ্বাস্তু হয়ে পড়া বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, জীবনযাপনের ঘটনাবলি।
চতুর্থ গ্যালারিতে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালির প্রতিরোধ গড়ে তোলার নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, গণমানুষের দুরবস্থা, যৌথ বাহিনীর অভিযান, বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ঢাকায় পাকিস্তানি দখলদারদের আত্মসমর্পণ—এই ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে শেষ গ্যালারিটি।
ভবনটির ভূগর্ভে রয়েছে তিনটি তলা। ওপরের ছয়টি তলায় অফিস মিলনায়তন, পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, ক্যানটিন, প্রদর্শনী কক্ষ—এসব। শিখা অনির্বাণ প্রথম তলায়।
আপনি স্বাধীনতায় সন্ধিৎসু হলে, আপনার সন্তান-সন্ততিদের বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে জানাতে হলে অন্তত একবার মুক্তিযুদ্ধ জাদূঘরটি পরিদর্শন করে আসুন। প্রবেশ মূল্য মাত্র ২০ টাকা ।
মজিবর রহমান খোকা : মুক্তিযোদ্ধা ও প্রকাশক